আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী
পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার দেবোত্তর কবি বন্দে আলী মিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহতাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দূর্নীতি, সভাপতির স্বাক্ষর জালিয়াতি করে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। আয়বর্হিভূত ভাবে বহুতল বাড়ি নির্মাণ ও সন্তানকে বিপুল অর্থের বিনিময়ে বেসরকারি মেডিকেলে পড়ালেখা করানোর বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সীমাহীন অনিয়ম, দূর্নীতি, জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাত অভিযোগ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট একাধিক দপ্তর ও দুদকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা আমিরুল ইসলাম রাঙা।
লিখিত অভিযোগ উল্লেক করা হয়েছে, বীরমুক্তিযোদ্ধা আমিরুল ইসলাম রাঙার ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় আটঘরিয়া উপজেলা পরিষদ গেটের বিপরীতে দেবোত্তর কবি বন্দে আলী মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি সুন্দর পরিবেশে ও সুন্দর ভাবে পরিচালিত হয়ে আসছিল। বিগত ১৬ অক্টোর ২০০৯ সালে মাহতাব উদ্দিন প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর থেকে ক্রমাগত ভাবে তিনি সীমাহীন দূর্নীতি ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। ইতোমধ্যে কৌশলে ও সভাপতির স্বাক্ষর জালিয়াতি করে অনিয়ম ও দূর্নীতির আশ্রয় নিয়ে বিপুল পরিমান অর্থ আত্মসাৎ করেন। সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা আমিরুল ইসলামের স্বাক্ষর জাল ও জালিয়াতি করে ব্যাংক লেনদেন, শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন বিল স্বাক্ষর ও রেজ্যুলেশনে সিন্ধান্ত গ্রহণ করে জালিয়াতির আশ্রয় নেন।
লিখিত অভিযোগে জানা যায়, প্রধান শিক্ষক মাহতাব উদ্দিন বিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ে কোন স্বচ্ছতা রাখেননি। আর্থিক নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সরকারি অনুদান সম্পূর্ণ ভাবে আত্মসাৎ করেছেন। অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক দায়িত্ব গ্রহণের পর বিগত ১৪ বছর ম্যানেজিং কমিটি গঠনে নির্বাচন হয়নি। তাঁর সহপাঠী, বাল্যবন্ধু ও অনুগতদের নিয়ে কমিটি গঠন করেন। ম্যানেজিং কমিটির নিয়মিত সভা করে না। প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত রেজুলেশন ভূক্ত করে সদস্যদের স্বাক্ষর গ্রহণ করা হয়। সভাপতি ও সদস্যদের স্বাক্ষর নকল করার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত স্থানীয় সোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকে সভাপতির স্বাক্ষর জালিয়াতি করে আর্থিক লেন-দেন করার প্রমাণ আছে।
জানা যায়, বর্তমান ম্যানেজিং কমিটি ২০২২ সালে জুন মাসে গঠিত হয়। কমিটি গঠণের সাথে সাথে অফিস সহকারী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ প্রদান করে ২৩ লক্ষ টাকা গ্রহণ করে। এছাড়া বিধি বহির্ভূতভাবে অফিস সহায়ক এবং দুইজন ল্যাব সহকারী নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আনুমানিক ২০ লক্ষ টাকা গ্রহণ করেন। বিষয়টি প্রকাশ্য চলে আসলে তাকে ঘুষ গ্রহণ করার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। সে শিক্ষক কর্মচারী ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের নিকট ১৫ লক্ষ টাকা গ্রহণের কথা স্বীকার করে এবং উক্ত অর্থ বিদ্যালয়ের ফান্ডে জমা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এছাড়া বিধিবহির্ভূত ভাবে নিয়োগ দেওয়া অফিস সহায়ক মোঃ ফাহিম ও ল্যাব সহকারী মোঃ আশিকুর রহমানের ১৫ লক্ষ টাকা ফেরত দেয়।
ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা আমিরুল ইসলাম রাঙা অভিযোগ করেন, গত ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে সহকারী প্রধান শিক্ষকের অবসরজনিত শূন্যপদে এবং ল্যাব সহকারী পদে দুইজনকে বেআইনিভাবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য বলা হলে তিনি নিয়োগ দিতে অসম্মতি জানান। এবং প্রধান শিক্ষকের আর্থিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ২০২৩ সালের জুন মাসে ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক তিনজন শিক্ষক সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। বিদ্যালয় সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনা করার জন্য সহকারী প্রধান শিক্ষকের শুন্যপদে একজন সিনিয়র শিক্ষককে অস্থায়ী ভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, বিদ্যালয়টি সুষ্ঠু এবং নিয়ম মাফিক পরিচালিত হওয়ার প্রায় ছয় মাস অতিবাহিত হলে প্রধান শিক্ষক গত ডিসেম্বর /২৩ থেকে সমস্ত সিদ্ধান্ত অমান্য করে আসছেন। ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্ত অমান্য করে হিসাব কমিটি বাতিল এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষককে অমান্য করা এবং বিদ্যালয়ে আদায়কৃত অর্থ ব্যাংকে জমা না দিয়ে নিজের কাছে রেখেছেন বলে অভিযোগ করেন।
সরেজমিনে গিয়ে ও বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট বিভিন্নজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রধান শিক্ষক মাহতাব উদ্দিন কমিটির দাতা সদস্য মোস্তাফিজুর রহমানকে অবৈধ ভাবে দাতা সদস্য করেছেন। আব্দুস সামাদ নামের যাকে অভিভাবক সদস্য করা হয়েছে তার কোন সন্তান এই প্রতিষ্ঠানে পড়েনি। সাড়ে ১৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে অফিস সহকারী পদে নাজমুল হোসেনকে এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে আরিফুল ইসলামকে সাত লক্ষ টাকায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিদ্যালয়ের স্টোর থেকে নৈশ প্রহরী আবদুল লতিফ, পিয়ন আবদুল আলীম ও পরিছন্নতা কর্মী মোঃ আরিফুল ইসলামের উপস্থিতিতে দেবোত্তর এলাকার জনৈক ব্যবসায়ীর নিকট ১৩০০ কেজি বই বিক্রি করেছেন। এভাবে ইতোপূর্বেও বই বিক্রি করেছেন। সরকার প্রদত্ত একটি ল্যাপটপ চুরি হয়ে যাওয়ার কথা বলে সেটা গোপনে সড়িয়ে দিয়েছেন। থানায় জিডি বা অভিযোগ করা হয়নি। বিদ্যালয়ের তহবিল থেকে ৬৫ হাজার টাকা নিয়ে আরেকটি ল্যাপটপ কিনে বাড়িতে রেখে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছেন। বিদ্যালয়ের তহবিল থেকে ৫২ হাজার টাকা মূল্যের দুইটা স্মার্ট মোবাইল ফোন কিনে ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করছেন। বিদ্যালয়ের একটি টেলিভিশন বাড়িতে নিয়ে রেখেছেন। ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্ত ব্যতিত বিদ্যালয়ের পূর্ব দক্ষিণ অংশে একটি দোকান বানিয়ে ভাড়া দিয়েছে। দোকান থেকে অগ্রিম টাকা নেওয়া এবং আদায়কৃত দোকান ভাড়া বিদ্যালয়ে জমা না দিয়ে নিজে গ্রহণ করেন। গত ডিসেম্বর মাসের ২০ তারিখ থেকে ছাত্র ভর্তি এবং সেসন ফি বাবদ আদায়কৃত আনুমানিক ছয় লক্ষ টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে নিজে গ্রহণ করেন। এই বিষয় নিয়ে সমালোচনার মুখে জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে দুই দফায় দেড় লক্ষ টাকা ব্যাংকে জমা দেয়। বাঁকী চার থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা সে জমা দেয় নাই। তিনি বিদ্যালয় থেকে আত্মসাৎ করা অর্থ দিয়ে বিদ্যালয় সংলগ্ন চারতলা (আটটি ফ্ল্যাট) বিশিষ্ট একটি সুবিশাল বাড়ি বানিয়েছে। যা তার জ্ঞাত আয়ের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। তার পুত্রকে রাজশাহীর বেসরকারি ইসলামি ব্যাংক মেডিক্যাল কলেজে বিপুল অর্থ দিয়ে পড়াশোনা করাচ্ছেন। তার ছেলে বর্তমানে ফাইনাল ইয়ারে অধ্যায়ন করছে। বিভিন্ন জনের কাছে সে প্রকাশ করেছে তার ছেলের পড়াশোনার জন্য প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাট লক্ষ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। এই টাকার উৎস কি?
দেবোত্তর বাজারের একাধিক সচেতন নাগরিকের দাবী, এপার বাংলা ওপার বাংলার খ্যাতনামা কবি বন্দে আলী মিয়ার স্মৃতিতেই এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের সুনাম রক্ষার্থে প্রধান শিক্ষক মাহতাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অনিয়ম, দূর্নীতিসহ নানা অভিযোগগুলো তদন্ত করে অপরাধ প্রমানিত হলে প্রয়োজনীয় আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের জোর দাবী জানান।
সংশ্লিষ্ট অভিযোগের বিষয়ে প্রধান শিক্ষক মাহতাব উদ্দিন বলেন, সভাপতি প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় নিয়মিত নন। প্রতিটা কাজ ও সিদ্ধান্ত তার সাথে আলোচনা সাপেক্ষে করা হয়েছে। তার পছন্দের লোককে নিয়োগ দেয়া নিয়ে কমিটির ১১ সদস্যের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়ায় কমিটির সদস্যরা বোর্ডের কাছে পদত্যাগ করেছেন। বর্তমানে কোন কমিটি নেই। ইউএনও স্বাক্ষরে বেতনভাতা উত্তোলন হচ্ছে। এডহক কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। স্বার্থের জায়গায় সভাপতির ইচ্ছামাফিক কাজ না করায় তিনি আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা ও মনগড়া অভিযোগ উত্থ্যাপন করেছেন। আদৌত আমার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগগুলো সঠিক নয়।
আটঘরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোঃ নাহারুল ইসলামের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ করলেও তিনি কোন মন্তব্য করেননি।