এম এ আলিম রিপন
পৌষের কাকডাকা ভোর থেকে শ্রমজীবী মানুষের হাঁকডাক। স্থানীয়সহ নাটোর,বগুড়া,রংপুর, সিরাজগঞ্জ,কুষ্টিয়া,গাইবান্ধা ও অন্য বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলা থেকে দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ এসেছেন সুজানগর উপজেলা বিভিন্ন স্থানের শ্রম বেচাকেনার হাটে। সারিবদ্ধভাবে বসে আছেন সড়কের পাশে । এরা প্রত্যেকেই সাথে নিয়ে এসেছেন ব্যাগ অথবা প্লাস্টিকের বস্তায় করে নিজের ব্যবহারের পোষাকসহ অন্যান্য জিনিসপত্র। প্রতি বছরের মতো এ বছরও পেঁয়াজের চারা রোপনের এ মৌসুমে প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সুজানগর উপজেলার বোনকোলা,পোড়াডাঙ্গা,দুলাই, মধুপুর, রাণীনগরসহ উপজেলা বিভিন্ন স্থানে বসে এ হাট। অভাবী এসব পুরুষ ও যুবক শ্রমিকদের মজুরিতে বনিবনা হলে মহাজন বা অন্য কাজের জন্য নিতে আসা লোকের পিছু পিছু চলে যাচ্ছেন তাদের বাড়ি। তবে শ্রম বিক্রির হাটে শ্রমিক বেচাকেনার বিষয়ে দরদাম নির্ভর করে বয়সের ওপর। শারীরিকভাবে দুর্বল ও বয়স্কদের দাম যুবকদের তুলনায় কিছুটা কম। স্থানীয়বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২যুগেরও অধিক সময় থেকে পেঁয়াজের চারা রেপনের এই মৌসুমে সুজানগরে শ্রমিক বেচাকেনা হয়ে আসছে। শ্রম বেচতে আসা এসব শ্রমজীবী মানুষ যেদিন শ্রম বিক্রি করতে পারবেনা,সেদিন তাদের রাত কাটে মসজিদ,মাদ্রাসা কিংবা স্কুলঘরের বারান্দায়। কখনো আধপেট বা কখনো উপোষ করে রাত কেটে যায় তাদের। সকাল হতেই আবার শ্রম বিক্রির আশায় ছুটে যান হাটে। নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম থেকে সুজানগরের বোনকোলা হাটে শ্রম বিক্রি করতে এসেছেন ষাটোর্ধ্ব আনিস শেখ। তিনি জানান প্রায় ১৫ বছর ধরে তিনি শ্রম বিক্রির জন্য এ অঞ্চলে আসেন । এ সময় তিনি বললেন তার দুঃখের কথা। মানুষ কিনে নিয়ে গতর খাটিয়ে কাজ করায়, কঠোর পরিশ্রম করার পরও বেশিরভাগ সময়েই খিচুড়ি ও ডাউল দিয়ে খেতে হয়। শোয়ার জন্য যেখানে রাখে সেখানে বৃষ্টির পানি ও কুয়াশা পড়ে। এসব বলতে বলতে আনিস শেখের দু’চোখের কোণে পানি জমতে থাকে এবং বলেন তারপরও পরিবারের জন্য কিছু টাকা রোজগার করে দিতে পারছেন এটাই শান্তি। এ সময় তিনি বলেন ভাই গরিব হয়ে জন্মাইলে কষ্টের শেষ নাই। বগুড়ার শেরপুর থেকে আসা নাজিম উদ্দিন নামে অপর একজন বলেন নিজ এলাকায় তেমন কোন কাম নেই,তাই আইছি কামে। কিছু টাকা আয় করে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবো এই আশায়। উপজেলার কামালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর ছাত্র আশিক বলেন, বার্ষিক পরীক্ষা দেবার পর থেকে বিদ্যালয় বন্ধ থাকে ও জানুয়ারী মাসে ক্লাস কম হয় তাই বাড়তি কিছু টাকা রোজগার করে সংসারে সচ্ছলতার আনার জন্য তিনি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে থাকেন। তার মত আরো অনেক ছাত্রই দিনপ্রতি ৫০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা করে এবং দিনে দুইবেলা খাবার খাওয়ার মাধ্যমে দিনমজুর হিসেবে এই পেঁয়াজের চারা রোপন করে থাকেন। রাণীনগর বিলগাজনা কলেজের মতিন নামে ছাত্র বলেন গতবার তিনি পেঁয়াজ রোপনের মৌসুমে ১৫হাজার ৫শত টাকা রোজগার করেছিলেন আর এবারের মৌসুমেও ২৪ থেকে ২৮ হাজার টাকা রোজগার করতে পারবেন বলে জানান । আর এই রোজগারকৃত টাকা দিয়ে এবারে একটি ভাল মোবাইল ফোন,বই ও জামা কাপড় কিনবেন বলে জানান। শনিবার উপজেলার মথুরাপুর গ্রামের আব্দুল কাদের বলেন, এবারে আমার প্রায় ২০ বিঘা জমিতে পেঁয়াজের চারা রোপন করতে মধুপুর হাটে শ্রমিক নিতে এসেছি। এসে দেখি শ্রমিকেরা আগের বছরের মতো দামটা একটু বেশি চায়। অনেকের সঙ্গে কথা বলে তাদের সব খরচসহ প্রতিদিন ছয়শত টাকা করে শ্রমিক নিয়েছি। উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ রাফিউল ইসলাম শনিবার জানান,বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম বিল হিসেবে পরিচিত সুজানগর উপজেলার গাজনার বিল সহ এই উপজেলার বেশিরভাগ ফসলি জমিতে নতুন চারা পেঁয়াজ রোপন শুরু করেছেন কৃষকেরা । দেশে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদনকারী উপজেলার মধ্যে সুজানগর উপজেলা অন্যতম। এ অঞ্চলের কৃষকদের কাছে এই পেঁয়াজই অন্যতম প্রধান অর্থকারী ফসল এবং এটি তারা জমিতে রোপন করবে আগামী জানুয়ারী মাস জুড়ে । এবারে এই উপজেলায় ১৭হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে নতুন এ পেঁয়াজের চারা রোপনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে । তবে এবারে কৃষকেরা বেশি পরিমাণ জমিতে পেঁয়াজের চারা রোপন করায় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে আশা করা হচ্ছে। এবং প্রতি বিঘা জমিতে এই পেঁয়াজের চারা রোপন করতে অন্তত ১৫-২০ জন শ্রমিক প্রয়োজন হবে।