নির্মল সরকার ঃ পাবনার বেড়া উপজেলার বিস্তীর্ণ মাঠ সরিষার হলুদ ফুলে ফুলে ঢাকা পড়েছে। মাঠ জুড়ে চাষ করা হচ্ছে সরিষা। যেদিকে দু’চোখ যায় মাঠে শুধু সরিষা ফুলের সমারোহ। হলুদে হলুদে ভরে গেছে কৃষকের মাঠ। সরিষার হলুদ ফুলের হলুদ রঙয়ে রাঙিয়ে দিয়েছে গ্রামীন জনপদ। মাঠের পর মাঠ যেন হলুদের রঙের আভায় উদ্ভাসিত। হলুদ রঙে সেজেছে বাংলার মেয়ে। হলুদ ফুলের হাসিতে দুর হয়ে যায় ক্লান্তি,স্বপ্ন সুখে উজ্জীবিত বেড়ার কৃষক।
উপজেলা কৃষি অফিস সুত্রে জানা যায়, চরাঞ্চল সহ বেড়া উপজেলায় ৪ হাজার ৭শ’ ৩০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও চাষ করা হয়েছে ৪ হাজার ৮শ’ ৮০ হেক্টর জমিতে। সরিষার দাম ও চাহিদা বেশী,অনুকুল পরিবেশ এবং চাষাবাদে খরচ কম হওয়ায় বেড়ার সরিষা চাষিরা এ মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১শ’৫০ হেক্টর জমিতে বেশী সরিষার চাষ করেছেন।
উপজেলার মোট সরিষা চাষের ৫০ ভাগ সরিষা চাষ হয় চরাঞ্চল সহ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে পূর্ব পাশে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এ বছর সরিষার বাম্পার ফলন হবে এমনটাই আশা করেছেন কৃষি কর্মকর্তা সহ সরিষা চাষীরা।
উপজেলার চাকলা গ্রামের কৃষক জয়নাল হক জানান, তিনি এ মৌসুমে ৫ বিঘা জমিতে বারি-১৪ জাতের সরিষা চাষ করেছেন,রোগ বালাই না হলে ভালো ফসল হবে এমনটাই আশা করছেন। ঢালার চর ইউনিয়নের কৃষক ছাত্তার আলী বলেন, অন্যান্য ফসলের তুলনায় সরিষা চাষে খরচ অনেক কম। সরিষার জমিতে সার,সেচ ও কীটনাশকের প্রয়োগ একেবারেই কম। নভেম্বর মাসের শুরুতে সরিষার চাষ শুরু হয়। ফলন পাকতে ৭৫ থেকে ৯০ দিন সময় লাগে। এখন চলছে মাঝামাঝি সময়। সমতল ও তুলনা মুলক উঁচু জমি সরিষা চাষের জন্য উপযুক্ত। হালকাভাবে জমি কর্ষণ, সার প্রয়োগ এর পর সরিষার বীজ বপন করতে হয়। বীজ থেকে চারা গজানোর ৩ থেকে ৪ সপ্তাহের মধ্যে এক বার উপরি ভাবে সামান্য সার ছিটিয়ে দিলেই সহজে ফলন ভাল হয়। তুলনামুলক কম পরিশ্রমে বেশি লাভ হওয়ায় দিন দিন সরিষা চাষে আগ্রহ বাড়ছে এ অঞ্চলের কৃষকদের।
উপজেলার হাটুরিয়া নাকালিয়া ইউনিয়নের চর নাকালিয়া গ্রামের কৃষক আনছার আলী বলেন, আমি ৩ বিঘা জমিতে টরি-৭ জাতের সরিষা চাষ করেছি,সরিষার ক্ষেত ফুল ফুলে ছেয়ে গেছে। আশা করছি ফলন ভাল হবে। সরিষা চাষ করার পরও ধান চাষ করা যায়, স্বল্প সময়ে এ ফসলটি ঘরে তোলা যায় বলে আমরা সরিষা চাষ করে থাকি।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ নুসরাত কবীর বলেন, কৃষকদের সরিষা সহ রবি শস্য চাষে আগ্রহ সৃষ্টির জন্য উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এ মৌসুমে প্রায় ২ হাজার ৬০০ জন কৃষকের মাঝে বিনা মূল্যে বীজ ও সার সরবরাহ করেছে। কৃষি কর্মকর্তা,উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সহ উপজেলা কৃষি অফিস সার্বক্ষনিক কৃষকদের পরামর্শ এবং সমস্যার সমাধান করে যাচ্ছে। চলতি মৌসুমে ৬ হাজার ৪শ’৯৬ মেট্রিক টন সরিষা উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে । সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা চেয়েও এবার কৃষক অনেক বেশী জমিতে সরিষার চাষ করেছেন। গত বছরে সরিষা ভালো ফলন ও বাজার মূল্য বেশী হওয়ায় এ মৌসুমে সরিষার আবাদ আশানুরুপ বৃদ্ধি পেয়েছে।
কুয়াশার কারনে সরিষার গাছ ও ফুলের ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা মো.ইউসুব আলী জানান,বর্তমান আবাহাওয়া সরিষার চাষের জন্য উত্তম, সামান্য কুয়াশায় সরিষার ফুলে কোনো ক্ষতি করতে পারে না, তবে বেশ কয়েক দিন দিনের অধিকাংশ সময় যদি কুয়াশা থাকে তবে সরিষা ফুলের ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা থাকে। সরিষা চাষের পর ওই জমির উর্বরতা শক্তি, উৎপাদন ক্ষমতা এবং ফসলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। এই রবি ফসল সরিষা পরবর্তী ফসল উৎপাদনের সহায়ক হিসেবে কাজ করে। সরিষা চাষ উপযোগী আবহাওয়া অনুকূলে থাকায়, চলতি মৌসুমে উপজেলায় সরিষার বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা আশা করছে কৃষি বিভাগ। কৃষি অফিস আরও জানায়, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ৩ হাজার ৫শ’৮০ হেক্টর জমিতে বারি সরিষা-১৪, ১৫ এবং নতুন উদ্ভাবিত উন্নত ফলনশীল জাত বারি-১৭ও টরি-৭ চাষ করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক কৃষকদের পরামর্শ প্রদান করছেন।
সরিষা চাষীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সরিষা গাছে পর্যাপ্ত পরিমান ফুল এসেছে,আবহাওয়ার বিপর্যয় না ঘটলে চলতি মৌসুমে সরিষার ফলন বিঘা প্রতি ৬ থেকে সাড়ে ৬ মণ হবে বলে তারা আশা করছেন। সরিষা চাষ পরবর্তী বোরো ধান চাষের জন্য অনেক উপকারী। সরিষা চাষের পর সরিষার গাছ জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। সরিষা চাষে বিঘা প্রতি ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫শ’ টাকা খরচ হয়ে থাকে। ভালো ফলন হলে এক বিঘা জমি থেকে ৬ থেকে সাড়ে ৬ মন সরিষা পাওয়া যায়। বর্তমানে প্রতি মণ সরিষার বাজারমূল্য ৩ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ৪ হাজার টাকা বিক্রি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রতি বিঘা জমি থেকে সব খরচ বাদ দিয়ে প্রায় ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা লাভ হবে। সরিষা চাহিদা ও বাজার মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় শাক-সবজি চাষের পাশাপাশি সরিষার আবাদেও ঝুঁকেছে এলাকার কৃষক, ফলে চলতি মৌসুমে সরিষার আবাদ কিছুটা বেড়েছে। সরিষার আবাদের পরই জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা যায়। এতে জমিতে সার কম ব্যবহার হয়, সরিষার পাতা ও শিকড় সবুজ সারের কাজ করে এবং বোরো ধানের ফলনও বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
সরিষা ফুলের মন মাতানো গন্ধ সবাইকে আকৃষ্ট করে। মাঠে মাঠে সরিষার হলুদ ফুলের সমারোহ। এসব ফুল থেকে মধু আহরণ করছে কোটি কোটি মৌমাছি। উপজেলায় প্রচুর পরিমানে সরিষার চাষ হওয়ায় মৌচাষিরা তাদের মৌবাক্স সরিষা ক্ষেতের পাশে,ক্ষেতের আলে বসিয়ে বছরের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছে। প্রচুর পরিমানের মধুর উৎসের উপযুক্ত নির্যাস পাওয়া যায় সরিষা ফুল থেকে।
দিগন্ত জোড়া সরিষার ফুল ফসলের মাঠগুলোতে এনেছে বৈচিত্র। এ বছর বাম্পার ফলনের হাতছানি দেখা দেওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। সরিষা ফুল থেকে মৌমাছি মধু সংগ্রহ করছে সেই সঙ্গে কৃষকের পরম বন্ধু হয়ে পরাগায়নের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির সহায়তা করে যাচ্ছে। মৌমাছির গুঞ্জন আর মৌ মৌ গন্ধে হলুদের আলপনায় এক স্বগীয় পরিবেশ তৈরী হয়েছে। অনাবিল এক শান্তির পরশ মানুষকে প্রকৃতির সাথে একাত্ম করে দেয়,মনের আসে অফুরান্ত প্রশান্তি।
আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে চলতি মৌসুমে উপজেলার সরিষার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন বেড়া উপজেলা কৃষি সম্প্রাসারণ অধিদপ্তর, সরিষার বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করছেন বেড়ার কৃষক।
বেড়ার বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে সরিষার চাষ; হলুদ ফুলের আভায় উদ্ভাসিত মাঠ প্রান্তর
বেড়া
5 Mins Read
Previous Articleসুজানগরে মণে হাজার টাকা কমে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২৫০০-২৭০০টাকায়
এই সম্পর্কিত আরো খবর পড়ুন
Add A Comment