হেলালুর রহমান জুয়েল
দেশের উত্তর জনপদের অন্যতম নদী,পদ্মা ও যমুনার মধ্যে যোগসূত্র প্রমত্ত বড়াল এখন অনেকটা মরা খালে পরিণত হয়েছে। দখল ও দূষণে ধুঁকছে দেশের অন্যতম নদ বড়াল। মারাত্মক সব কেমিক্যাল বর্জ্যে অনেক আগেই দূষিত হয়েছে এ নদের পানি। কচুরিপানায় এখন ভরপুর। বাতাসে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধময় বিষ। বড়ালের তলদেশে জমাট বেঁধেছে পলিথিনের স্তর আর রকমারী বর্জ্য। সর্বোপরি নদকে গিলে খাচ্ছে পলিথিন,পোড়া তেল, মবিল, পৌরসভার পয়ঃবর্জ্য, গৃহস্থালী ও হোটেল রেস্তোরার বর্জ্য ও নদের পাড়ে নির্মিত মুরগী,মাছ ও মাংসের বাজার ও কাঁচা পায়খানা। বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে নদটি। আজ ১৪ মার্চ বিশ^ নদী কৃত্য দিবসে বড়াল চালুর দাবি পরিবেশবাদীদের।
চলনবিল অঞ্চলের গুমানী,চিকনাইসহ অন্যান্য নদীও নাব্যতা হারিয়ে শুকনো নদীতে পরিণত হয়েছে। পানিশূন্য বড়াল এখন শুধুই হাহাকার। এককালের ¯্রােতস্বিনী বড়ালের বুকে এখন ধান চাষ হচ্ছে। দখল আর দূষণে বড়ালের অস্তিত্ব এখন বিলীন হতে চলেছে। বড়াল মরে যাওয়ায় দেশের বৃহত্তম বিল চলনবিল পানি সংকটে শুকিয়ে যাওয়ায় বিস্তীর্ণ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। তেমনি এ অঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকাকে করে তুলেছে বিপর্যস্ত।
চলনবিলের প্রাণ এবং পদ্মা ও যমুনা নদীর একমাত্র যোগসূত্র বড়াল নদ এখন শুকিয়ে গেছে। মশক উৎপাদনের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। একই সাথে বড়াল পাড়ের বিভিন্ন হাট-বাজার,পৌরসভার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে বড়াল নদে। এ নদের বুক জুড়ে এখন আবাদ ধান,গম,সরিষা ও রসুনের। কিছুদিন আগেও যে বড়াল থেকে তীরবর্তী মানুষের পানির চাহিদা মিটে আশেপাশের জমিতে আবাদ হতো,বর্তমানে সে বড়ালের বুকেই অগভীর নলকূপ বসিয়ে চলছে ধান চাষ। একসময় যে নদে পাল তোলা নৌকা চলতো, সে নদ এখন সবুজ-শ্যামল ফসলের মাঠে পরিণত হয়েছে। এই বড়াল নদকে রক্ষা করতে ২০০৮ সালে চাটমোহরে গড়ে ওঠে বড়াল রক্ষা আন্দোলন। এই আন্দোলনে সহযোগিতা করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা),বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা),এএলআরডিসহ বিভিন্ন সংগঠণ। বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির উদ্যোগে বড়াল পাড়ের ২২০ কিলোমিটার দীর্ঘ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া সভা-সমাবেশ,কর্মশালার মাধ্যমে এলাকাবাসী বড়াল সংস্কারের দাবি জানায়। বড়াল নদের বাঁধ ভেঙে ব্রিজ করার দাবিতে আন্দোলন বেগবান হয়। বেলা বড়াল রক্ষায় হাইকোর্টে রিট করেন। এসবের পর সরকার বড়াল মুক্ত করার উদ্যোগ নেয়। শুরু হয় বড়াল অবমুক্ত কার্যক্রম। ইতোমধ্যেই বড়াল নদের চাটমোহর উপজেলার নতুন বাজার হাইস্কুল মোড়.নতুন বাজার খেয়াঘাট,বোঁথর ঘাটে ও রামনগরে ব্রিজ নির্মাণ হয়েছে। দহপাড়ায় পাউবোর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ অপসারণ করে নির্মিত হয়েছে ব্রিজ। সরকারের মন্ত্রী,এমপি একাধিকবার বড়াল দেখতে চাটমোহরে এসেছেন। সচল হয়েছে জেলা ও উপজেলা নদী রক্ষা কমিটি। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানসহ সরকারে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও একাধিকবার বড়াল নদ পরিদর্শন করেছেন।
এদিকে বাঁধ ও স্লুইসগেট ভেঙে ব্রিজ নির্মাণ,দখল-দূষণ বন্ধ ও নদী খনন করে বড়াল নদ চালু করার দাবি জানিয়েছেন পরিবেশবাদীরা।
উল্লেখ্য,রাজশাহীর চারঘাটে পদ্মার শাখা হিসাবে উৎপন্ন হয়ে দুইশ’ ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ বড়াল নদ পুঠিয়া, বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলার মধ্যদিয়ে বাঘাবাড়ি হয়ে হুরা সাগরের বুকে মিশে নাকালিয়া এলাকায় যমুনায় পড়েছে। প্রখ্যাত লেখক প্রমথনাথ বিশী লিখেছেন, মুর্শিদাবাদ থেকে নদীপথে ঢাকায় আসার সংক্ষিপ্ত পথ হওয়ায় তৎকালীন নবাব-বাদশাহরা যাতায়াতের জন্য বড়াল নদকেই ব্যবহার করতেন। যোগাযোগ সুবিধার কারণে বড়াল নদের দুই পাড়ে প্রশাসনিক ভবনসহ বিভিন্ন হাট-বাজার ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা গড়ে উঠে। এ নদীতীরে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য জনপদ। সে সময় নদটি ছিল পূর্ণ যৌবনা। ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে পানি উন্নয়ন বোর্ড চারঘাটে বড়ালের উৎসমুখে তিনটি গেটবিশিষ্ট মাত্র পাঁচ হাজার কিউসেক পানি ডিসচার্জ ক্ষমতাসম্পন্ন রেগুলেটর (বাঁধ) নির্মাণ করে। ফলে বড়াল সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। শুরু বাঁধ নির্মাণ,দখল প্রক্রিয়া। স্থাপন করা হয় একাধিক স্লুইসগেট এবং নদের বুক চিরে রাস্তা করায় পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। বড়ালে পানি না থাকায় এখন নদীপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কচুরিপানায় পরিপূর্ণ বড়াল। শুষ্ক মওসুমে এলাকার কৃষকরা নদের বুক জুড়ে ফসলের আবাদ করেছেন।
এ অবস্থায় বিশ্ব নদীকৃত্য দিবসের প্রাক্কালে বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব এস এম মিজানুর রহমান দ্রুত বড়াল নদ পুনঃখনন করাসহ দখল-দূষণ বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।
তিনি বলেন,চারটি জেলার লাখ লাখ মানুষ বড়ালের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। বড়াল পাড়ের মানুষসহ সকলেই অবিলম্বে নদীর পুনঃখনন ও দখল-দূষণ বন্ধের দাবি জানাচ্ছে। নদ দখলকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। বড়াল চালু করা এখন সময়ের দাবি।
আজ বিশ্ব নদী কৃত্য দিবস; দখল-দূষণ আর নাব্যতা হারিয়ে বড়াল এখন মরা খাল ও আবাদ হচ্ছে ফসলের
চাটমোহর
3 Mins Read
Previous Articleস্বল্প মুল্যে দুধ ডিম ও ঘি বিক্রি হচ্ছে লাইব্রেরী বাজারে শুভ উদ্বোধন করলেন এমপি প্রিন্স
Next Article চাটমোহর বিশ^ ভোক্তা অধিকার দিবসে আলোচনা সভা
এই সম্পর্কিত আরো খবর পড়ুন
Add A Comment