প্রতিবছর ৩১ জানুয়ারি হতে ৩১মে সময়ের মধ্যে ফারাক্কায় প্রবাহিত পানির পরিমাণের ভিত্তিতে পানি বন্টন হবে বলে নির্ধারণ করা হয়। চুক্তির শর্তানুযায়ী সংকটের সময়ে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি সরবরাহের গ্যারান্টি রয়েছে। ৩০ বছর মেয়াদী চুক্তি ২০২৬ সালে নবায়নের কথা। ১৯৬১-১৯৭৫ সোয়া ২ কি.মি লম্বা ফারাক্কা ব্যারেজ তৈরি হয়। এখান থেকে ভাগীরথী-হুগলি নদীর ফিডার খালটির দৈর্ঘ্য ৪০ কি.মি.। বাংলাদেশের তিস্তা চতুর্থ বৃহত্তম একটি নদী যা সিকিম থেকে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশের রংপুর দিয়ে প্রবেশ করেছে। তিস্তার উজানে ড্যাম-বাঁধ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশ প্রতিবছর ১৫ লাখ টন বোরো ধান উৎপন্ন হতে বঞ্চিত যা মোট উৎপাদনের ৯ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) পাবনা জেলা শাখার আয়োজনে গতকাল ২২ সেপ্টেম্বর বিশ^ নদী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. এ কে এম শওকত আলী খান এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) পাবনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হামিদ খানের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন পাবনা সরকারি মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আখতার জামান, পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারি পরিচালক মোঃ মোশাররফ হোসেন, পুলিশের প্রাক্তন আর আই মোঃ শমসের আলী, ছড়াকার মোঃ মহসিন, মোঃ শামসুদ্দোহা প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন বাপা সদস্য মোঃ রেজাউল করিম।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে শওকত আলী খান বলেন, ইউরোপ ভিত্তিক ইউএনইসি-এর মাধ্যমে ইউরোপ কান্ট্রিগুলো তাদের সব আন্তঃসীমান্ত নদীর পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করেছে। আমরা দাবি করি বাংলাদেশ জাতিসংঘের মাধ্যমে ভারতের সাথে যত আন্তঃসীমান্ত নদী আছে সেসব নদীর পানির নায্য হিস্যা বুঝে পাক। অর্থাৎ আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার ‘ ভারতকে প্রত্যেকটি আন্তঃসীমান্ত নদীর পানির নায্য হিস্যা দিতে হবে’। কারণ আন্তঃসীমান্ত নদীর নায্য পানি পাওয়া আমাদের অধিকার। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা-মেঘনাসহ অন্যান্য সকল নদীর নায্য হিস্যা বাংলাদেশের জন্য নিশ্চিত করতে হবে। সেইসাথে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপ, মানববন্ধনসহ নানামুখী কর্মসূচী গ্রহণ করে সারাদেশকে জাগিয়ে তুলতে হবে। এই নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে। প্রয়োজনে জাতিসংঘের সহায়তা নিয়ে বিশ^ দরবারে পানির নায্য অধিকার আদায়ের জন্য ভারতকে চাপ দিতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পাবনা মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক, কথাসাহিত্যিক আখতার জামান বলেন, বাংলাদেশের জীব বৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ পুরোটাই নদী নির্ভর। নদীর সাথে এদেশের মানুষের বাঁচা-মরার সম্পর্ক। যেহেতু নদীকে মহামান্য হাইকোর্ট জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে, সেহেতু নদীর উপযোগিতার অর্থনৈতিক মূল্যমান বিচারের উর্দ্ধে। হাজার রকম প্রজাতির প্রাণী-উদ্ভিদ প্রবাহমান নদীর সাথে বেঁচে থাকে। অথচ খুবই দুঃখের সাথে লক্ষ্য করা যায় যে, বাংলাদেশ বিগত দিনগুলোতে নদীর ব্যবস্থাপনা নিয়ে খুব বেশি উদ্যোগী হয়নি। বরং এখানে উল্টো কাজ হয়েছে, অভ্যন্তরীন নদীগুলোকে দখলের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে, মাছ চাষের নামে অসংখ্য বাঁধ, অপরিকল্পিত ব্রীজ-কালভার্ট, বালু উত্তোলন ইত্যাদির মাধ্যমে নদীমাতৃক এদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশকেই সংকটের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে বড়ো দুশ্চিন্তার কারণ হলো, প্রতিবেশী দেশ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে আমাদের নদীর পানি প্রবাহের গতিপথ পাল্টে দিয়ে বাংলাদেশকে খরা ও বন্যাকবলিত জনপদে পরিণত করে ফেলেছে। তিনি বলেন, এসব নদীর সাথে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষের অস্তিত্বের সম্পর্ক। তাই আমাদের এখনই এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি উল্লেখ করেন, জনসচেতনতা সৃষ্টি করে আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে নদীর পানির নায্য হিস্যা আদায় এবং অভ্যন্তরীন নদী দখলমুক্ত করে পানিপ্রবাহ সৃষ্টির বাস্তবধর্মী ও বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
পানি উন্নয়নে বোর্ডের সহকারি পরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, বর্তমানে সমগ্র পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অববাহিকা অঞ্চলের জনসংখ্যা বৃদ্ধি, পানির নানাবিধ ব্যবহার, মিল কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে নিক্ষেপ, মানুষের উন্নত জীবনযাত্রার মোহ এবং নদীদখল প্রক্রিয়ার ফলে বাংলাদেশের নদীভিত্তিক অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপন্ন-প্রায় অবস্থায় চলে এসেছে। তিনি পাবনার ইছামতি নদীর কথা উল্লেখ করে বলেন, বাপা’র নেতৃত্বে পাবনাবাসী মৃতপ্রায় ইছামতি নদী নিয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। পাবনাবাসীর আন্দোলন-সংগ্রাম আজ বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। বলা যায় পাবনার ইছামতি আবার প্রাণ ফিরে পাচ্ছে।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) পাবনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট সাংবাদিক-কলামিস্ট আব্দুল হামিদ খান বলেন, ফারাক্কাসহ উজানের অসংখ্য বাঁধ ও প্রকল্পের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে চলেছে ভারত। ফলে পদ্মার বুকে নতুন নতুন চর দেখা দিচ্ছে। এই চর খেয়ে ফেলছে নদীর পানি। ফলে সঙ্কুচিত হয়ে চলেছে নদীর মূল প্রবাহ। অথচ এই নদী একটি আন্তঃসীমান্ত নদী বা আন্তঃদেশীয় নদী। ভারতে যা গঙ্গা নামে পরিচিত, আমাদের দেশে সেটিই পদ্মা। সুতরাং এই আন্তঃসীমান্ত নদী গঙ্গার পানির ওপর আমাদের নায্য অধিকার রয়েছে। এটা ভারতের একার বিষয় না। কারণ এটা বাংলাদেশের ওপর দিয়েও প্রবাহিত হয়েছে। তিনি বলেন, ফারাক্কা ও তিস্তা বাঁধের কারণে অন্যান্য নদ-নদী যেমন ভরাট হয়ে গেছে তেমনি ভারতের ঢলের পানি আমাদের দেশে বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেন, নদী রক্ষায় বাংলাদেশের এখনও কার্যকর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা নেই। আমাদের দেশের সব নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। পানি ধারণক্ষমতা একেবারেই কমে গেছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনার ভিত্তিতে খনন করে নদীর গভীরতা বাড়াতে হবে। নদী খননের নামে প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে লুটপাট করা হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়না। লুটপাট বন্ধ করে , দুর্নীতিমুক্ত ভাবে নদী খনন করলে আমাদের দেশের নদীগুলোর এই অবস্থা হতো না। পাশাপাশি ভারতের বিভিন্ন ব্যারেজের বিকল্প বাঁধ তৈরি করে ভারতের দেয়া পনিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল যাতে ডুবে না যায় তার বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে এবং নদীর পানি সারাবছর সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
ভারতকে প্রত্যেকটি আন্তঃসীমান্ত নদীর পানির নায্য হিস্যা দিতে হবে – পাবনায় বিশ^ নদী দিবসে আলোচনা সভায় বক্তারা
পাবনা সদর
4 Mins Read
Previous Articleআটঘরিয়া থানায় নতুন ওসির যোগদান
Next Article তৌহিদী জনতা ভেঙে দিল রামচন্দ্রপুরের লালন আখড়া
এই সম্পর্কিত আরো খবর পড়ুন
Add A Comment